Total Pageviews

Tuesday, October 11, 2011

মানসিক স্বাস্থ্যের ভালো-মন্দ

মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী

অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, জেরিয়াট্রিক ও অর্গানিক সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।

শরীরের ছোটবড় যেকোনো সমস্যায় আমরা ব্যাকুল হয়ে পড়ি, উপস্থিত হই হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু এই রক্ত-মাংসে গড়া শরীর ছাড়াও আমাদের জীবনে যে মন বলে আরেকটি উপাদানের অস্তিত্ব আছে তা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। মনকে বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য নয়। আর মনের স্বাস্থ্যই হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য। মানসিক স্বাস্থ্য, মনের রোগ, মানসিক সমস্যা ইত্যাদি কথা আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষই সহজভাবে নিতে চায় না। আরেকটি অপব্যাখা হলো যে মানসিক সমস্যা মানেই অহেতুক উত্তেজিত হওয়া, ভাঙচুর, মারামারি করা, অপরকে আক্রমণ করা। বাস্তবে মানসিক রোগীদের খুব ক্ষুদ্র অংশই এ লক্ষণগুলো প্রকাশ করে। এর বাইরে বেশির ভাগ মানসিক রোগী রয়েছে যাদের লক্ষণগুলো লঘু হলেও তা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করে। অথচ তারা কিন্তু চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে চায় না। তারা মনেই করে না যে তাদের কোনো মানসিক সমস্যা আছে বা আদৌ এর জন্য চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।
মূলত মানসিক সমস্যা দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা (সাইকোটিক ডিসঅর্ডার), যেখানে রোগী তার নিজের রোগলক্ষণগুলো সম্পর্কে মোটেই সচেতন থাকে না, তার যে রোগ আছে তা কখনোই স্বীকার করে না। কিন্তু অন্যরা লক্ষ করে। তাদের চিন্তা, আচরণে চরম অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, কোনো যুক্তিতেই তাদের চিন্তা বা আচরণকে সমর্থন করা যায় না। এই গুরুতর মানসিক রোগের মধ্যে আছে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডার, মেজর ডিপ্রেশন (বিষণ্নতা) ইত্যাদি।
আরেক ধরনের মানসিক সমস্যা রয়েছে মৃদু মানসিক সমস্যা বা নিউরোটিক ডিসঅর্ডার, যেখানে রোগী নিজেই টের পায় যে তার মধ্যে কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা আছে এবং এর থেকে তার পরিত্রাণ পাওয়া দরকার। যেমন অতি উদ্বেগ (অ্যাংজাইটি), অহেতুক ভয় (ফোবিয়া), কনভার্সন ডিসঅর্ডার, সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
মানসিক রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ হলো:

চিন্তার অস্বাভাবিকতা: যুক্তিযুক্ত চিন্তা করতে না পারা, অবাস্তব অলীক চিন্তা করা। চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলা, এক চিন্তা থেকে দ্রুত সম্পর্কহীন বিষয়ে চিন্তা করা। মনে করা যে চিন্তা চুরি হয়ে যাচ্ছে বা রেডিও-টিভিতে চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে। চিন্তার মধ্যে অন্য কারও চিন্তা অনুপ্রবেশ করছে। চিন্তা ও কথার অসংলগ্নতা।

হ্যালুসিনেশন (অলীক প্রত্যক্ষণ): কোনো ধরনের উদ্দীপনার উপস্থিতি ছাড়াই তা প্রত্যক্ষণ করা। অর্থাৎ ঘরে কেউ নেই অথচ কানে কথা শোনা, সামনে কিছু নেই অথচ কিছু দেখা, গায়ে কিছুর স্পর্শ অনুভব করা।

অহেতুক সন্দেহ: কোনো কারণ ছাড়াই অন্যকে সন্দেহ করা। রোগী মনে করে অন্যরা তার ক্ষতি করতে চায়, তার খাবারে বিষ মেশাতে চায়, তাকে নিয়ে নানা বদনাম রটাতে চায় ইত্যাদি।

বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত হওয়া: মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করতে পারে যে তার চিন্তা, আচরণ কোনো কিছুই তার নিজের নয়, অন্য কেউ বা বাইরের কোনো শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
নিজের সম্পর্কে অতি উঁচু ধারণা: নিজেকে অতিরিক্ত ক্ষমতাধর বলে ভাবা। নিজের ক্ষমতার অতিরিক্ত কোনো কিছু করার চেষ্টা করা। নিজেকে অসম্ভব বড় কোনো চরিত্রে কল্পনা করা।

নিজের সম্পর্কে তুচ্ছ ধারণা: সব সময় মনে করা যে সে খুবই তুচ্ছ। তাকে দিয়ে কিছু হবে না, সে জীবনের সব ক্ষেত্রেই পরাজিত। তীব্র হতাশা। নিজের সম্পর্কে সব সময় নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা।

ঘুমের সমস্যা: প্রায় সব ধরনের মানসিক সমস্যায় ঘুমের নানা রকম সমস্যা হয়। ঘুম আসে না, আবার কখনো ঘুমিয়ে গেলে ঘুম ভেঙে যায়। আবার কখনো রোগী মনে করে যে তার ঘুমানোর কোনো দরকার নেই। একটানা কয়েক দিন না ঘুমিয়ে কাটায়। আবার অতিরিক্ত ঘুমও হতে পারে।

খাদ্য গ্রহণের সমস্যা: খিদে কমে যাওয়া, খেতে না চাওয়া, খেলেও বমি করে দেওয়া অথবা অতিরিক্ত পরিমাণে বেশি খাওয়া বা সব সময় ভালো খাবার খেতে জেদ ধরা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। আবার কখনো মিথ্যা সন্দেহের কারণে বিশেষ খাবার গ্রহণ না করা।

এলোমেলো আচরণ: স্বাভাবিক আচরণ না করা। যেমন ময়লায় গড়াগড়ি, অখাদ্য গ্রহণ, সবার সামনে কাপড় খুলে ফেলা, খারাপ কথা বলা ইত্যাদি। আবার কখনো বিনা উসকানিতে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, ভাঙচুর, মারামারি করা ইত্যাদি।

একই কাজ বারবার করা: একই কাজ বারবার করা, একই চিন্তা বারবার মনের মধ্যে আসা। যেমন বারবার হাত ধোয়া, বারবার টাকা গোনা, অনাকাঙ্ক্ষিত চিন্তা বারবার আসা।

অহেতুক ভয়: ভয় মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা, কিন্তু যখন এই ভয় অহেতুক বা অযৌক্তিক হয় তখন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত। এই ভয় কোনো বিশেষ বস্তু বা বিষয়ের প্রতি হতে পারে, আবার সার্বিকভাবে সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে পারে।

ব্যাখ্যাতীত শারীরিক লক্ষণ: অনেক সময় কিছু শারীরিক লক্ষণ দেখা যায়, যেটার কোনো ব্যাখ্যা বা কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরীক্ষায় শরীরে কোনো রোগের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও যদি শারীরিক লক্ষণ থেকে যায় তবে তা মানসিক কারণে হচ্ছে কি না তা যাচাই করে নেওয়া জরুরি। যেমন কোনো কারণ ছাড়াই হাত-পা, বুক ব্যথা, মাথাব্যথা, বিনা কারণে বমি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, শরীরের একদিক বা সারা শরীর অবশ ভাব ইত্যাদি।

অসামাজিক আচরণ: সমাজবিরোধী আচরণ বারবার করা, অন্যের সঙ্গে মিশতে না পারা, নিজের ক্ষতি নিজে করা—হাত কাটা, চুল ছেঁড়া ইত্যাদি। পশুপাখিকে বিনা কারণে কষ্ট দেওয়া, হত্যা করা।

আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা: কেউ যদি আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করে তবে অবশ্যই তার কোনো মানসিক সমস্যা আছে কি না তা যাচাই করে নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে এসব লক্ষণের বাইরেও অন্যান্য লক্ষণ থাকতে পারে আবার এসব লক্ষণ থাকলেই যে তার মানসিক রোগ আছে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। একমাত্র মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞই তার রোগ সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করতে পারেন।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Facebook Themes