Total Pageviews

Wednesday, October 5, 2011

 স্থূলতা কমাতে সার্জারি!

ওজন কমাতে নিয়মিত হাঁটার বিকল্প নেই ওজন কমাতে নিয়মিত হাঁটার বিকল্প নেই
অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইনোলজি
ও মেটাবলিজম বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল।

বিশ্বজুড়ে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ স্থূলতা রোগে ভুগছে এবং ৬৪ শতাংশ মানুষ ভুগছে ওজনাধিক্য রোগে। হ্যাঁ, স্থূলতাকে এখন আমরা একটি রোগ হিসেবেই দেখি। শুধু তা-ই নয়, ভয়ংকর অসংক্রামক ব্যাধিগুলো, যেমন—উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদেরাগ, ক্যানসার ইত্যাদির মূল সহযোগী রোগ হিসেবে মূল্যায়ন করি। স্থূলতা শুধু যে এই রোগগুলোরই কারণ তা নয়, এটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মৃত্যুঝুঁকি। রোগীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক দুরবস্থার কারণ এবং স্বাস্থ্য খাতে একটি আন্তর্জাতিক বিপর্যয়। সবচেয়ে খারাপ কথা হলো, দুই থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে দ্রুত এ রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে, বিশ্বজুড়ে ১৭ শতাংশ টিনএজারই হচ্ছে স্থূলকায় এবং ভবিষ্যতে এই সংখ্যাটি আরও বড় রকমের বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে।

স্থূলতা কেন কমাতে হবে
একজন স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী ব্যক্তির চেয়ে অধিক ওজনের ব্যক্তির ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির আধিক্য, হূদেরাগ ও পিত্তথলির রোগ হওয়ার আশঙ্কা অনেক গুণ বেশি। এ ছাড়া স্থূল রোগীদের হাঁটু ব্যথা, কোমরে ব্যথা, অস্টিওআথ্রাইটিস, ভ্যারিকোস ভেইন ও ফ্যাটি লিভার হতে পারে। সম্প্রতি আলোচিত ভয়ংকর রোগ স্লিপ এপনিয়া, যাতে ঘুমের মধ্যে অকস্মাৎ শ্বাসযন্ত্র বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতে পারে, তারও মূল কারণ স্থূলতা। স্তন ক্যানসার, কোলন ক্যানসার, প্রস্টেট ক্যানসার ইত্যাদির সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া স্থূলতা মানসিক চাপ বাড়ায়, কর্মক্ষমতা কমায়, লেখাপড়া ও চাকরিতে বিঘ্ন ঘটায়, বিষণ্নতা তৈরি করে। স্থূল শিশু-কিশোরেরা মানসিক চাপ ও টিজিংয়ের শিকার হয়। মোটকথা, স্থূলতার কোনো ভালো দিকই নেই।

কীভাবে বুঝবেন আপনার ওজন বেশি
ওজনাধিক্য যাচাই করার বেশ কয়েকটি চালু পদ্ধতি আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয় বিএমআই এবং ওয়েস্ট সারকামফেরেন্স বা পেটের মাপ পদ্ধতি। আমাদের এশীয় শরীর গঠন অনুযায়ী পেটের ভুঁড়ি বরাবর ফিতা দিয়ে মাপলে তা পুরুষের ৯০ সেন্টিমিটার ও নারীদের ৮০ সেন্টিমিটারের কম হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন যা হওয়ার কথা সেই মাপটিকে বলা হয় বিএমআই। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির বিএমআই (ওজনকে মিটারে উচ্চতার দ্বিগুণ দিয়ে ভাগ করলে যা হয়) ১৮ দশমিক ৫ থেকে ২৪ দশমিক ৯-এর মধ্যে থাকা উচিত। ২৫-এর ওপরে গেলে তাকে বলা হয় ওজনাধিক্য বা ওভারওয়েট, ৩০-এর ওপরে গেলে স্থূল বা ওবেস এবং ৪০-এর ওপরে গেলে ভয়াবহ রকমের স্থূল বা মরবিড ওবেস।

কেন আপনি স্থূল হলেন
আপনি অনেক কারণেই স্থূল হতে পারেন। এর পেছনে আপনার পারিবারিক ইতিহাস, বেড়ে ওঠার গল্প, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কাহিনি জানাটা খুবই জরুরি। আপনি এমন কোনো ওষুধ খাচ্ছেন কি না, যা ওজন বাড়াতে সহায়ক হতে পারে, যেমন—জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ, সেটাও জানাতে হবে চিকিৎ সককে। আপনার এমন কোনো রোগ আছে কি না, যে কারণে স্থূলতা হতে পারে, যেমন—থাইরয়েডের অসুখ, কুশিং সিনড্রোম বা বিষণ্নতা রোগ, তাও জানা দরকার। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন, কেন আমি অন্যদের চেয়ে মোটা। আমি কী ধরনের খাবার খাই, কতটা খাই? কবে শেষ আমি কায়িক পরিশ্রম করেছিলাম? কবে থেকে আমি খেলাধুলা ছেড়ে দিয়েছি? অফিসে বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কত ঘণ্টা আমি স্রেফ ডেস্কে বসে কাটাই? বাড়িতে ফিরে কত ঘণ্টা আমি টিভি বা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকি? দৈনিক কতক্ষণ হাঁটি? আশা করি, এসব প্রশ্নের মধ্যেই আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন।

আপনি স্থূল, এবার?
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলো যে আপনি স্থূলতা রোগে ভুগছেন। আর এর জন্য আপনার জীবনাচরণই মূলত দায়ী। এবার কী করবেন?
 প্রথমেই দেখে নিন স্থূলতার জন্য আপনার কী কী ক্ষতি হয়ে গেছে এবং হতে চলেছে। রক্তচাপ, রক্তের সুগার, রক্তের চর্বি ইত্যাদি মাপিয়ে নিন। এই রিপোর্টগুলোর ওপর আপনার পরবর্তী অনেক পদক্ষেপ নির্ভর করছে।
 আপনার কাঙ্ক্ষিত ওজনের টার্গেট ঠিক করে নিন। অতি উচ্চাভিলাষী হবেন না। ধরে নিন, আপনি আগামী ছয় মাসে আট থেকে ১০ কেজি ওজন কমাবেন, এর বেশি নয়।
 আপনার চিকিৎ সা-পদ্ধতি কী হবে, তা আপনার বিএমআই এবং আনুষঙ্গিক রোগবালাইয়ের ওপর নির্ভর করে। ওভারওয়েট হলে শুধু জীবনযাত্রা পরিবর্তন করলেই চলে, স্থূল হলে বা আনুষঙ্গিক মারাত্মক রোগ থাকলে ওষুধ দিয়ে চিকিৎ সা করা যেতে পারে। বর্তমান বিশ্বে বিএমআই ৪০-এর ওপর হলে বা আনুষঙ্গিক মারাত্মক রোগ থাকলে তার কমেও ওজন কমানোর অপারেশন ব্যারিয়াট্রিক সার্জারির চর্চা হচ্ছে।

ওজন কমানোর ওষুধ এবং সার্জারি
ওজন কমানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়, কিন্তু দুঃখের বিষয় এর কোনোটিই স্থায়ীভাবে ওজন কমাতে সক্ষম হয়নি। তার ওপর এগুলোর নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। তবে ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি ওজনকে দীর্ঘস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ ও উপশম করার ক্ষেত্রে যে কার্যকরী, তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বেশি ওজনের সহযোগী রোগগুলো, যেমন—উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বন্ধ্যত্ব, স্লিপ এপনিয়া ইত্যাদিরও স্থায়ী উপশম লাভ করা যেতে পারে এর দ্বারা। বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি প্রচলিত, যেমন—গ্যাস্ট্রিক ব্যান্ডিং, গ্যাস্ট্রোপ্লাস্টি, বিলিওপ্যানক্রিয়েটিক ডাইভারসন, অ্যাডজাস্টেবল গ্যাস্ট্রিক ব্যান্ড ইত্যাদি। সুখের বিষয় এই অতি বিশেষায়িত সার্জারিও আজকাল বাংলাদেশে সহজলভ্য হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশি শল্য চিকিৎ সকেরা সফলতার সঙ্গে এই সার্জারি সম্পাদন করেছেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্ট ও বাংলাদেশ অ্যান্ডোক্রাইনোলজি সোসাইটি আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক ওবেসিটি কনফারেন্সে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। ভারতের পুনেতে অবস্থিত লেপারো-ওবেসো ক্লিনিকের প্রখ্যাত ব্যারিয়াট্রিক সার্জন শশানক শাহ ও ব্যারিয়াট্রিক ফিজিশিয়ান পুনম শাহ এই কনফারেন্সে যোগ দেন ও বাংলাদেশি সার্জন-পুষ্টিবিদদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।

ওজন কম রাখতে যা করবেন
 নিজের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কত হওয়া উচিত, তা হিসাব করে সেই ওজন অনুযায়ী ডায়েটিশিয়ানের কাছ থেকে একটি খাদ্যতালিকা করে নিন। দৈনন্দিন সব খাদ্য এই তালিকায় থাকবে, কিন্তু তার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকবে।
 রন্ধনপ্রণালি ও খাদ্য উপাদান নির্বাচনে পরিবর্তন আনুন। রেড মিট, যেমন—গরু-খাসির মাংস বাজার ফর্দ থেকে বাদ দিন। ফ্রাই বা ভাজা, বেক করা খাবার, পনির, ঘি বা চকলেটসমৃদ্ধ খাবার বাদ দিন। সেদ্ধ, কম তেলে রান্না, কাঁচা সালাদ বা ফলমূল বেশি করে নির্বাচন করুন।
 প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট জোরে হাঁটা বা জগিং করা শুরু করুন। এমনভাবে হাঁটতে হবে যেন হূৎ স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে পড়ে, ঘাম ঝরে। ধীরে ধীরে হাঁটার পরিধি বাড়ান। নিয়মিত হাঁটুন।
 জীবনযাত্রায় কায়িক পরিশ্রম যোগ করুন। লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, সব সময় গাড়িতে না চড়ে হেঁটে বাজারে যান। বাড়ির কাজে হাত লাগান। বাগান করুন, সাঁতার কাটুন।
 দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনুন। রেস্তোরাঁয় গেলে কোক, ফান্টা খেতেই হবে—এমন কোনো কথা নেই, মিনারেল ওয়াটারও অর্ডার দেওয়া যায়। মেয়নেজ ছাড়া সালাদ বা ফলের রস চেয়ে নিতে পারেন। সুপার শপে চকলেট, আইসক্রিমের তাকগুলো বাদ দিয়ে ফলমূল ও কাঁচা সবজির তাকের দিকে চোখ দিন। নেমন্তন্নে যাবেন না তা হয় না, নিশ্চয় যাবেন। কিন্তু রিচ ফুড যথাসম্ভব পরিহার করুন। দরকার হলে বাড়ি থেকে রুটি-সবজি খেয়ে রওনা দিন, যাতে খিদে মরে যায়।

ওজন কমাতে যা করবেন না
 উচ্চাভিলাষী হবেন না। খুব দ্রুত ওজন কমাতে গেলে কিছুদিন পরই ক্লান্তি চলে আসবে এবং ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করুন।
 না বুঝে, না জেনে অতিরিক্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করবেন না। এতে পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা, ভিটামিনের অভাব ও হাড় ক্ষয় হতে পারে। খাদ্যতালিকা করতে চিকিৎ সক বা পুষ্টিবিদের সাহায্য নিন।
 প্রথমেই অতিরিক্ত হাঁটা বা জিম করতে গেলে শরীরে ব্যথা ও ক্লান্তি চলে আসতে পারে। ধীরে ধীরে ফিটনেস বাড়াতে হবে।
 বাজারে প্রচলিত টোটকা, হারবাল, মেদভুঁড়ির ওষুধ, নানা রকমের যন্ত্রপাতির বিজ্ঞাপনে কখনো ভুলবেন না। এগুলো স্বাস্থ্যহানিকর।
 লেসার বা লাইপোসেকসনের মাধ্যমে স্থূলতার চিকিৎ সা করা হয় না। এগুলো স্বীকৃত চিকিৎ সা-পদ্ধতি নয়।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Facebook Themes