Total Pageviews

Tuesday, October 11, 2011

 বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১১- প্রয়োজন মহৎ উদ্যোগ

মানসিক স্বাস্থ্যকে আর অবহেলা নয়, হতে হবে সচেতন মানসিক স্বাস্থ্যকে আর অবহেলা নয়, হতে হবে সচেতন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
প্রেষণে: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছরের ১০ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৯৬ থেকে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ দিবসটিতে একটি করে প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করে আসছে। এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মহৎ উদ্যোগ নিন: মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করুন’ (দি গ্রেট পুশ: ইনভেস্টিং ইন মেন্টাল হেলথ)। ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বিষয়টির সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত হলেও এটিকে এড়িয়ে চলা বা গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে খানিক বেশি। অথচ বর্তমান সময়ে সমস্ত পৃথিবীতে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। যেকোনো আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের নাগরিক, ধর্ম-বর্ণ ও বয়সনির্বিশেষে মানসিক অসুস্থতার শিকার হতে পারে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, অভিবাসন, মাদকের অপব্যবহার এবং বৈশ্বিক ধ্যানধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি। বাংলাদেশে মানসিক রোগীর হার হচ্ছে মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ১৬.১ শতাংশ শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮.৪ শতাংশ। বাংলাদেশে এই বিপুলসংখ্যক মানসিক রোগীর বিপরীতে রয়েছে অপ্রতুল জনবল আর নগণ্য বাজেট বরাদ্দ। বাংলাদেশে ১৫ লাখ মানুষের জন্য গড়ে একজনেরও কম মনোযোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন এবং মনোযোগ বিশেষজ্ঞের মধ্যে অধিকাংশই রয়েছেন শহরাঞ্চলে। মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে শয্যার সংখ্যা সরকারি পর্যায়ে মাত্র ৮২৮টি। ২০০৫ সালে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বরাদ্দের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ। অথচ সহস্রাব্দের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য বাজেটের ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের সুুপারিশ করেছে। মানসিক স্বাস্থ্য খাতে প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশের চিত্রই এক রকম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩০ শতাংশ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো স্থান নেই— ২৫ শতাংশ রাষ্ট্র তাদের স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ খরচ করে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে। চিকিৎসাসুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উন্নত দেশে ৩৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ এবং অনুন্নত দেশে ৭৬ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ গুরুতর মানসিক রোগী তাদের রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ১২ মাসের মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা গ্রহণ করে না। স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে গড়ে প্রতি এক লাখ লোকের জন্য শূন্য দশমিক ০৫ জন মনোরোগবিশেষজ্ঞ ও শূন্য দশমিক ১৬ জন মনোরোগ নার্স আছেন। এ জন্যই এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে মহতী উদ্যোগে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই বিনিয়োগ কেবল আর্থিক বিনিয়োগ নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে নীতিনির্ধারক মহলের মেধা আর শ্রমের বিনিয়োগ, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সর্বসাধারণের মনোযোগের বিনিয়োগ। সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আমরা মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি।
১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, ‘কেবল নিরোগ থাকাটাই স্বাস্থ্য নয়; বরং শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকার নামই স্বাস্থ্য।’ অথচ কার্যত এই সংজ্ঞার খণ্ডিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয় প্রতিনিয়ত—কখনো সচেতনভাবে আবার কখনো অসচেতনতায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ‘স্বাস্থ্য’ শব্দটি সীমাবদ্ধ হয়ে ছিল ‘শারীরিক’ অংশটুকুর মধ্যে। তবে আশার কথা এই যে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বিষয়টি ধীরলয়ে প্রবেশ করছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল আঙিনায়।
কিন্তু একুশ শতকের উপযোগী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সবার আগে দরকার বিদ্যমান অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ রূপ প্রদান এবং সে জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের নীতিমালা প্রণয়ন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে মানসিক স্বাস্থ্যকে আনুপাতিক গুরুত্ব দেওয়া এবং প্রয়োজনে আলাদা মানসিক স্বাস্থ্যনীতি তৈরি করা দরকার। এ ছাড়া বাংলাদেশে যে অপ্রতুলসংখ্যক মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন, তার ঘাটতি মোকাবিলায় আরও দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং পাশাপাশি বিদ্যমান জনশক্তির মানোন্নয়নে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। মাঠপর্যায়ের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও বেশি মানসিক রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। সাধারণ শিক্ষার হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যশিক্ষায় মানসিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং চিকিৎসাশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যকে নিয়ে আসতে হবে প্রথম সারিতে। মানসিক রোগীর পরিবারের সদস্য ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে মানসিক রোগ ও এর প্রতিকার-সংক্রান্ত বিষয়ে।
জনগণের দোরগোড়ায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রয়োজন ‘কম্যুনিটি মেন্টাল হেলথ সার্ভিস’, যার অর্থ হচ্ছে কেবল হাসপাতালে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নয় বরং এই সেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে ন্যূনতম মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো তৈরি করা। মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ‘অধিকতর’ বরাদ্দের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন ‘ন্যায্য’ বরাদ্দ। রোগ ও রোগীর চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ শ্রম, মেধা, মনোযোগ আর অর্থের বরাদ্দ প্রয়োজন। নাই নাই করেও বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অর্জন নেহাত কম নয়। প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে আলাদা দুটি জরিপের মাধ্যমে মানসিক সমস্যা, অটিজম, মৃগী আর মাদকাসক্তির প্রকোপ নির্ধারণ করা হয়েছে। মৃগী রোগের ট্রিটমেন্ট গ্যাপবিষয়ক গবেষণা, আন্তদেশীয় বিষণ্নতা পরিমাপক বিষয়ে গবেষণা, গ্লোবাল অ্যালকোহল সার্ভে ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গবেষণা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে, বিদ্যমান রয়েছে মাদকাসক্তি আইন। কেবল অসহায় মানসিক রোগীদের মানবাধিকার, চিকিৎসা, চাকরি ও অধিকার সংরক্ষণ বিধিমালাসংবলিত মানসিক স্বাস্থ্য আইনটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রায় সাতটি জাতীয় পর্যায়ের গাইড বই প্রণয়ন করা হয়েছে, যার আলোকে চিকিৎসক, সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মীসহ নানা পর্যায়ে কর্মরত জনশক্তি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে পারছে। কিন্তু এসব কার্যক্রম আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়োজন ‘মহৎ উদ্যোগ’। আর এই মহৎ উদ্যোগের ভার কেবল সরকার বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ওপর চাপিয়ে রাখলে চলবে না, প্রত্যেক সাধারণ মানুষকে তাদের নিজ নিজ শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তনে অংশ নিতে হবে। মানসিক রোগীকে অবহেলা করে নয়, সমাজ থেকে লুকিয়ে রেখে নয় বরং বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসাসেবার আওতায় যত দ্রুত সম্ভব তাকে নিয়ে এসে রাষ্ট্রের উৎপাদশীলতায় তাকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Facebook Themes