Total Pageviews

Wednesday, July 13, 2011

৯ মাসের বিপদ-আপদ

জরিনা বেগম, বয়স ২৫, গৃহিণী, স্বামী কৃষক। বাড়ি কুড়িগ্রাম। দুই কন্যা সন্তানের জননী, বর্তমানে আবার গর্ভবতী। স্বামী হুমকি দিয়েছে আবার কন্যা সন্তান প্রসব করলে তালাক দেবে। তাই গর্ভকালীন তার প্রতি গুরুত্ব ছিল একেবারেই কম, এমনকি প্রসব বেদনার সময়ও। গ্রামের ধাত্রীকে ডেকে আনা হলো। অবস্থা খুবই জটিল জেনেও স্বামী হাসপাতালে নিতে রাজি হলো না। ২৪ ঘণ্টা কষ্টের পর জরিনা এক মৃত পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে নিজেও মারা গেলেন। পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এলো। শোকটা জরিনার জন্য নয়, মৃত পুত্রসন্তানের জন্য।
রাহেলা খাতুন, বয়স ২২, এক পুত্রসন্তানের জন্মের চার বছর পর পরবর্তী সন্তানের জন্মের তারিখ খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। গভীর রাতে প্রসব বেদনা উঠল। কিন্তু প্রসূ'তি শেষ করে হাসপাতালে তাকে নিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর হাসপাতালে সে জন্ম দিল এক মৃত কন্যা সন্তান।
প্রথম ঘটনায় মৃত্যুর কারণ দৃষ্টিভঙ্গি, দ্বিতীয়টিতে যথাযথ প্রসূ'তির অভাব। মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার আমাদের দেশে আগের তুলনায় অনেক কমেছে কিন্তু এখনো যে পর্যায়ে আছে তা যথেষ্ট উদ্বেগের। গর্ভকালীন মাকে বাড়তি যত্ন নিতে হবে তার পরিবার থেকে, তাকে ও অনাগত শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে নিচের বিষয়গুলো লক্ষ রাখা দরকার।
  • মাকে সব সময় মানসিকভাবে উৎফুল্ল রাখা
  • পুষ্টিকর খাবার দেয়া
  • জন্মদান বিষয়ে সাহস জোগানো
  • ভারী কোনো কাজ করতে না দেয়া
  • সব সময় স্বাস্থ্যগত দিকটি নজরে রাখা
  • ভবিষ্যতে যেকোনো বিপদের জন্য নিজেদের প্রস'ত রাখা
তবে নিচের কয়েকটি বিষয় গর্ভবতীর মধ্যে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেগুলো হলো-
হঠাৎ রক্তপাত শুরু হলে
প্রসবের সময় ছাড়া গর্ভাবস্থায় যেকোনো সময় রক্তক্ষরণ বা প্রসবের সময় বা প্রসবের পর খুব বেশি রক্তক্ষরণ বা গর্ভফুল না পড়া বিপদের লক্ষণ। তাই এ রকম পরিসি'তির সৃষ্টি হলে কোনো রকম চিন্তা না করে পরিবারের সবারই উচিত মাকে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া এবং ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। অন্যথায় তা বাচ্চা এবং মা দুজনের জীবনেই হুমকি ডেকে আনতে পারে।
খিঁচুনি হলে
গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় বা প্রসবের পর যেকোনো সময় যদি খিঁচুনি দেখা দেয় তবে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষায়িত হাসপাতালে মাকে ভর্তি করাতে হবে। খিঁচুনি একলামসিয়ার প্রধান লক্ষণ। তাই দ্রুত পদক্ষেপ ও চিকিৎসা বাচ্চা এবং মা দুজনের জীবনকেই রক্ষা করতে পারে। তা না হলে এ রোগে দুজনই মারা যেতে পারে।
চোখে ঝাপসা দেখলে বা তীব্র মাথাব্যথা হলে
গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় বা প্রসবের পর শরীরে পানি আসা, খুব বেশি মাথাব্যথা বা চোখে ঝাপসা দেখা পাঁচটি প্রধান বিপদ চিহ্নের মধ্যে একটি। তাই এ ব্যাপারে মায়েদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। যদিও গর্ভাবস্থায় মায়ের পায়ে সামান্য পানি আসা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। একটু বেশি হাঁটলে এ পানি চলেও যায়। কিন' যদি পায়ে অতিরিক্ত পানি আসে এবং অস্বস্তির সৃষ্টি করে ও পা ভারী হয়ে আসে তবে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।
ভীষণ জ্বর হলে
গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর তিন দিনের বেশি জ্বর বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব প্রধান বিপদ চিহ্নের একটি। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় যদি কেঁপে কেঁপে ভীষণ জ্বর আসে এবং প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া হয়, তবে তা অনেক সময় মূত্রনালির সংক্রমণের ইঙ্গিত বহন করে। সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা করলে অল্প সময়ে এ জটিলতা দূর হয়ে যায়।
বিলম্বিত প্রসব হলে
প্রসবব্যথা যদি ১২ ঘণ্টার বেশি হয় অথবা প্রসবের সময় যদি বাচ্চার মাথা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ বের হয়ে আসে, বাসাবাড়িতে প্রসবের চেষ্টা না করে সবারই উচিত মাকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া।
লক্ষ রাখতে হবে গর্ভবতীকেও
এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদেরও এসব বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে। তা ছাড়া নিচের কয়েকটি বিষয়ে নিজেকেও খেয়াল রাখতে হবে।
বাচ্চার নড়াচড়া
গর্ভাবস্থায় সাধারণত মা ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করেন। পেটের ভেতর বাচ্চা ঘুমায় ও খেলা করে, যার অনুভূতি মা বাইরে থেকে বুঝতে পারেন। বাচ্চার নড়াচড়ার একটা নির্দিষ্ট সীমা এবং সময় রয়েছে যা শুধু মা-ই অনুভব করেন। এর কোনো ব্যতিক্রম হলে মা সেটা খুব দ্রুত বুঝতে পারেন। বাচ্চার অধিক নড়াচড়া বা কম নড়াচড়া দুটিই ক্ষতিকর এবং এসব ক্ষেত্রে নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর ডাক্তারকে দেখানো উচিত।
রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া
গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর মায়ের রক্তচাপ লক্ষ রাখা জরুরি। উচ্চ রক্তচাপ অনেক সময় মায়ের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং এটি একলামসিয়ার একটি লক্ষণও। তাই যারা আগে থেকেই রক্তচাপে আক্রান্ত বা গর্ভাবস্থায় উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের উচিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ সেবন করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নিজ ও বাচ্চা উভয়ের সুন্থতা নিশ্চিত করা।
তলপেটে তীব্র ব্যথা
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে (সাধারণত তিন মাসের মধ্যে) যদি কোনো সময় তলপেটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়, রক্তক্ষরণ ও পেট রক্ত হয়ে যায় তবে দ্রুত ডাক্তারকে দেখানো উচিত। এ ক্ষেত্রে জরায়ু ছাড়া নালিতে (অন্যান্য সন্তান যেমন- পেটের ভেতর, ডিম্বাশয়ের মধ্যে ইত্যাদি) গর্ভধারণ (যা একটোপিক প্রেগন্যান্সি নামে পরিচিত) হয়ে থাকে এবং অনেক সময় এটি ফেটে গিয়ে মায়ের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত অপারেশন ছাড়া মাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
তাই গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩৬ সপ্তাহে ন্যূনতম প্রতি মাসে একবার এবং ৩৬ সপ্তাহের পর প্রতি সপ্তাহে একবার করে মাকে স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তার দেখানো উচিত।
গর্ভকালীন সাধারণ সমস্যা
এর বাইরেও গর্ভকালীন সাধারণ কিছু সমস্যা দেখা যায়। যেমন-
বমি
সকালে ওঠার পর যদি বেশি অসুস্থবোধ হয় তবে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে হালকা কিছু যেমন- শুষ্ক টোস্ট বা সাধারণ বিস্কুট খেতে পারেন।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
  • দুশ্চিন্তা করবেন না
  • বমি হবে এই ভয়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করবেন না
বুকজ্বলা
  • অল্প অল্প করে প্রয়োজনে বারবার খাবার খান
  • বেশি মসলাযুক্ত খাবার পরিত্যাগ করুন
  • রাতে বুকজ্বলা শুরু হলে এন্টাসিড ট্যাবলেট চুষে খেতে পারেন
  • প্রয়োজনে ডাক্তার দেখান
কোষ্ঠকাঠিন্য বা পায়খানা কষা
  • প্রচুর পানি, আঁশযুক্ত খাবার ও শাকসব্জি বেশি করে খান
  • নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করে মাংসপেশির টান ঠিক রাখুন
গিলা ও পা ফোলা
  • অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন না
  • পা যতটা সম্ভব ওপরের দিকে রেখে শুয়ে থাকুন
  • রক্তচাপ পরিমাপ করাবেন
  • লবণ কম খাবেন
যোনির নিঃসরণ
সব মহিলারই গর্ভাবস্থায় যোনির নিঃসরণ বেড়ে যায়। এটা সাধারণত সাদা হয়, তবে গন্ধ থাকে না। যদি যোনির নিঃসরণ গন্ধযুক্ত, রঙিন হয় এবং আপনি অস্বস্তিবোধ করেন তবে বুঝতে হবে আপনার যোনিতে জীবাণুর সংক্রমণ হয়েছে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। একটু সচেতনতা ও পরিবার এবং চিকিৎসকের সামান্য সহযোগিতাই কমিয়ে আনতে পারে মা ও শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর হার।
গর্ভবতী মায়ের জন্য
  • সব সময় ধীরে ধীরে দাঁড়াবেন, কখনোই আচমকা দাঁড়াবেন না
  • এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকবেন না
  • প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন
  • বেশি লবণ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন
  • প্রচুর আঁশযুক্ত খাবার যেমন- রান্না করা অথবা কাঁচা ফল এবং সবুজ শাকসব্জি, সালাদ খাবেন
  • অল্প চর্বিযুক্ত ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খাবেন
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করবেন
  • ক্লান্তি-বোধ হলে কিছু সময় বিশ্রাম নিন
  • যতটা সম্ভব দুশ্চিন্তা পরিহার করুন
  • প্রতি রাতে অন্তত ৮ ঘণ্টা এবং দিনে ২ ঘণ্টা ঘুমাবেন। প্রয়োজনে বিকেলে বিশ্রাম নিন।
  • বাম কাত হয়ে ঘুমাবেন। এর ফলে বাচ্চার জন্য পুষ্টি ও অক্সিজেন বহনকারী রক্তনালির ওপর চাপ পড়বে না।
  • ডা. রাতু রুমানা
    সুনর্গডটইনফু

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Facebook Themes