Total Pageviews

Saturday, September 17, 2011

এটি একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখা

প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই শিরোনামটি দেখে ভাববেন, প্রতি সপ্তাহে স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ পাতা থাকা সত্ত্বেও এই পাতায় কেন স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখা? যে বিষয়টি আলোকপাত করছি তা হলো, ‘হূদেরাগ, এর ঝুঁকি এবং প্রতিকার’। অনেকেই হয়তো এই কথাগুলো জানেন, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে হূদেরাগের অনেক বড় বড় উদ্ভাবনী তথ্য, চিকি ৎ সা ও যন্ত্রপাতি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান অর্জন করাটা আজ হাতের মুঠোয়; কিন্তু বেসিক যে কথাগুলো জানা দরকার, সে জন্যই চিকি ৎ সক হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা থেকে এই লেখাটির ভাবনা।
আমরা জানি হূদ্যন্ত্র সম্পর্কে—‘হার্ট’ বা হূ ৎ পিণ্ড দেহের সবচেয়ে শক্তিশালী একটি মাংসপিণ্ড, যা প্রতি মিনিটে চার থেকে পাঁচ লিটার রক্ত পাম্প করে সারা শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রয়োজনীয় রক্তের চাহিদা মিটিয়ে চলছে আমৃত্যু। বলা যেতে পারে, হার্ট হচ্ছে আমাদের দেহের জন্য ‘মহান পুষ্টিদাতা’। তাই এর যত্ন নেওয়া অতীব জরুরি। বিশ্বব্যাপী এক নম্বর ঝুঁকিপূর্ণ এই হূদেরাগে বছরে প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। উদ্বেগজনক হলো, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগ দ্রুত বাড়ছে এবং বাংলাদেশের জনগণ এই ঝুঁকির শীর্ষে, যা চীনের জনগণের ছয় গুণ এবং জাপানিদের প্রায় ২০ গুণ। সুতরাং এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতার বিষয়টি সহজেই অনুমেয়; ‘সাডেন ডেথ’-এর অন্যতম প্রধান কারণ হূদেরাগ, বিশেষ করে ‘হার্ট অ্যাটাক’। কারা এই রোগের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন? যাঁদের বয়স চল্লিশোর্ধ্ব, যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে। অতিরিক্ত স্থূলতা, ওই রোগগুলোর পারিবারিক ইতিহাস এবং যাঁদের ধূমপানসহ অন্যান্য বদ-অভ্যাস রয়েছে, তবে কিছু ঝুঁকি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যেমন—পুরুষের বয়স ৪৫ বছর কিংবা বেশি এবং নারীদের বয়স ৫৫ বছর কিংবা বেশি। এ ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের চেয়ে সৌভাগ্যবতী। পুরুষের হূদেরাগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আবার কিছু ঝুঁকি আছে, যা আমরা চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি; যেমন—হাই কোলেস্টেরল! তার আগে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন এই যে কোলেস্টেরল নিয়ে এত হইচই! কোলেস্টেরলকে এত অপবাদ দিচ্ছি আমরা, এটা কি বিজ্ঞানসম্মত? উত্তর, না। কারণ, আমাদের শরীরের জন্য কোলেস্টেরল অত্যাবশ্যকীয়, যা রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে প্রবাহিত হয়। তবে এর মাত্রা যদি বেশি হয়, তা অবশ্যই ক্ষতিকর কারণ; তা রক্তনালির ভেতরে পলি জমায় এবং করোনারি ধমনির ভেতরে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং জন্ম হয় হার্ট অ্যাটাক নামের একটি আতঙ্কিত রোগের, যার পরিণাম নিশ্চিত মৃত্যু; যদি একে সঠিক সময়ে চিকি ৎ সা করা না যায়। বলা হয়ে থাকে, বুকে ব্যথা হলে রোগীকে সরাসরি ‘ক্যাথল্যাবে’ নিতে হবে এবং এনজিওগ্রাম করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একজন বিশেষজ্ঞ কার্ডিওলজিস্টের মাধ্যমে চিকি ৎ সা সম্পন্ন করাতে হবে। কিন্তু ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তো আর সেই সুযোগ নেই।
তাই প্রয়োজন অধিক সচেতনতা, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং বছরে কমপক্ষে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। তবে ঢাকায়ও যে অঘটন ঘটছে না, তা কিন্তু নয়! একটা ঘটনা বলছি, চার-পাঁচ দিন আগে, রাত দুইটা বাজে। ঝড়ের বেগে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকল। রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনেরা উদ্বিগ্ন ও উ ৎ কণ্ঠায়! ট্রলিতে ওঠানোর সময় রোগীর গায়ে আমার হাতের স্পর্শেই শীতল নিথর দেহের অনুভূতি পেলাম। বুঝলাম, সব শেষ হয়ে গেছে! তবু জরুরি বিভাগে সব ভাইটাল সাইন পরীক্ষা করে জানালাম যে চল্লিশোর্ধ্ব এই ভদ্রলোক অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছেন। কী হয়েছিল—জানতে চাইলে স্বজনেরা বললেন, সন্ধ্যা থেকে বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। তারপর নিজেই দোকানে গিয়ে রেনিটিডিন ওষুধ কিনে খেয়েছিলেন। পরে তাঁর নিজের রুমে কখন যে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে গেছেন, কেউ জানে না! জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর কি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হার্টের কোনো অসুখ ছিল? উত্তরে জানা গেল, না, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। কিন্তু চিকি ৎ সক হিসেবে বলব, তিনি অবশ্যই সুস্থ ছিলেন না। তাঁর হার্টের রক্তনালিতে হয়তো অজানা ব্লক ছিল, যার কোনো উপসর্গ এত দিন অনুভূত হয়নি বলে তিনি কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাননি। আমি যে বিষয়টি বোঝাতে চাইছি তা হলো, নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, নিয়মিত চিকি ৎ সকের কাছে যাওয়া এবং হেলথ চেকআপ করা আর না-করার পার্থক্য বোঝানোর জন্য বোধ করি উপরিউক্ত ঘটনাটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত! কীভাবে ভালো থাকবেন?
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রচুর রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল থাকতে হবে। অলিভ অয়েল, বাদামতেল, সয়াবিন তেল, চীনাবাদাম, সামুদ্রিক মাছ, বিশেষ করে ইলিশ মাছ শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কারণ, এতে ‘ওমেগা ত্রি ফ্যাটি এসিড’ নামের একধরনের ভালো চর্বি থাকে।
শরীরটাকে সুস্থ রাখতে হলে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট বা আড়াই ঘণ্টা কায়িক পরিশ্রম করতে হবে এবং তা ক্রমাগত বাড়াতে হবে। শিশুদের ভিডিও গেম, কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে না দিয়ে বাইরে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যথায় মোটা শিশু বা ‘চাইল্ড হুড ওবেসিটি’ এক ভয়াবহ ব্যাধিতে রূপ নেবে।
এবার জানুন কী কী খাবেন না—কাঁচা লবণ, গরু ও খাসির মাংস (রেড মিট), ডিমের কুসুম, গলদা চিংড়ি, ঘি, মাখন, পনির, মালাই, আইসক্রিম, ফুলক্রিম, বেকারি বিস্কুট, কেক পেস্ট্রি যত কম খাওয়া যায় ততই মঙ্গল। কারণ, এগুলো মুখরোচক খাবার ছাড়া কিছুই নয়।
যেসব ধূমপায়ী হূদেরাগ, ফুসফুসে ক্যানসার হবে জেনেও এখনো এই অভ্যাসটি ছাড়েননি, তাঁদের জন্য একটা দুঃসংবাদ—সেটা হলো, সিগারেট থেকে ‘পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ’ বা ‘বার্জার্স ডিজিজ’ নামে পায়ের এক অসুখ হয়, যার চিকি ৎ সা ওই পা কেটে ফেলে দেওয়া! সুতরাং ধূমপান ছাড়ার জন্য আপনার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।
যাঁদের ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো অসুখ রয়েছে, তাঁদের অবশ্যই মনোবল অটুট রেখে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে এবং তা যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনেকে যখন-তখন প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করে দেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এসব ক্ষেত্রে স্ট্রোকের মতো দুর্ঘটনা ঘটে। তাই আপনার চিকি ৎ সকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বন্ধ করবেন না। পরিশেষে বলছি, সামান্য কটি অর্থের জন্য নিজের শরীরকে ঝুঁকিতে রাখবেন না। যেকোনো উপসর্গকে গুরুত্ব দিন, আপনার চিকি ৎ সকের পরামর্শ নিন, কমপক্ষে বছরে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং মুক্ত থাকুন আকস্মিক মৃত্যুর হাত থেকে। কারণ, আপনি একা নন, আপনার দিকে তাকিয়ে আছে পরিবার-পরিজন। তাই হাসিমুখ চাই সবার।
আশীষ কুমার চক্রবর্তী
পরিচালক,
আয়েশা মেমোরিয়াল স্পেশালাইজ্ড হসপিটাল,
ঢাকা।
সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো

0 মন্তব্য(সমূহ):

Post a Comment

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Facebook Themes